তারিকুল হক তারিক
একতারা, দোতারা, ঢোল আর বাঁশির সুরে প্রকম্পিত এখন লালনের সাধন ভূমি কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়া। দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা লালনের ভক্ত-শিশ্য ও বাউলরা কালিগঙ্গার পাড়ে মত্ত হয়েছেন সাধন-ভজনে। তারা অবিরাম গেয়ে চলেছেন লালনের রেখে যাওয়া সব আধ্যাত্মিক গান। তাদের সঙ্গে সুর মেলাচ্ছেন দর্শনার্থীরাও। কুষ্টিয়া শহরতলীর ছেঁউড়িয়ায় গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে বাউল সম্্রাট ফকির লালন শাহের ১৩৪ তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে লালন উৎসব। বাংলা ১২৯৭ সালের পহেলা কার্তিক (ইংরেজি ১৬ অক্টোবর) সাধক পুরুষ লালন সাঁই এই ছেঁউড়িয়াতেই দেহত্যাগ করেন। এরপর থেকে তার অনুসারীরা কালিগঙ্গার তীরে ছঁউড়িয়ার আঁখড়া বাড়িতে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিনটি স্বরণ করেন। প্রতি বছরের মত এবারও সাধক লালনের দর্শন লাভের আশায় প্রাণের টানে ছুটে এসেছেন লাখো মানুষ। এ উৎসবকে ঘিরে এখন চলছে গুরু-শিষ্য ও ভক্ত-অনুসারীদের সাধন-ভজন আর মিলন মেলা।
”মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি” এই স্লোগানকে সামনে রেখে গতকাল সন্ধ্যায় এ উতসবের উদ্বোধন করেন পানি সম্পদ মন্ত্রনালয়ের উপদেষ্টা মিজ্ ফরিদা আখতার। কুষ্টিয়ার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক ও লালন একাডেমীর সভাপতি মোছা: শারমিন আখতারের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন মৎস ও প্রানী সম্পদ মন্ত্রনালয়ের সচিব সাঈদ মাহামুদ বেলাল হায়দর,ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ নসরুল্লাহ, পুলিশ সুপার মো: মিজানুর রহমান, জেলা বিএনপির আহবায়ক কুতুব উদ্দিন আহমেদ, জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ইন্জিনিয়ার জাকির হোসেন সরকার, ছাত্র জনতা প্রতিনিধি এসএম সুইট ও আলমাস হাসান মামুন প্রমুখ। অণুষ্ঠানে প্রধান আলোচক হিসেবে আলোচনা করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো: রশিদুজ্জামান। সাংস্কৃতিক মন্ত্রনালয়ের সহায়তায় কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন ও লালন একাডেমী এ উতসবের আয়োজন করেছে। উতসবের সাথে শুরু হয়েছে ৩ দিনের লালন মেলাও। এরআগে সুর্য ডোবার সাথে সাথে লালনের আখড়া বাড়িতে সমবেত হওয়া সাধু বাউলরা চাল-জ¦ল গ্রহনের মাধ্যমে তিরোধান দিবসের গুরু কর্মের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন। আজ শুক্রবার সকালে গোষ্ট গানের মাধ্যমে সাধুরা দ্বিতীয় দিনের আচার শুরু করবেন।
লালন মাজার ও আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সাম্প্রদায়িকতা, সহিংসতা এবং সংঘাত মুক্ত জাত-পাত হীন মানবধর্মের আদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে উৎসব স্থলে এসেছেন ভক্ত অনুসারিরা। সেই সাথে মরমী সাধক এই বাউল সম্রাটের জীবন-কর্ম, ধর্ম-দর্শন,সংগীত ও চিন্তা চেতনা থেকে শিক্ষা নিতে দেশ-বিদেশের লাখো ভক্ত অনুরাগী, দর্শনার্থী এখন ভীড় করেছে ছেঁউড়িয়ায়। এবারও ৩ দিনের উতসবে আলোচনা ছাড়াও প্রতিদিন গভীর রাত পর্যন্ত চলছে লালনের গান আর গুরু শিষ্যের আরাধনা। লালনের আখড়া বাড়িতে এবারের এই উতসব সাধু ভক্তদের ভাব বিনিময়ের মহা উৎসব হয়ে উঠেছে।
লালন ভক্তরা জানান, ফকির লালন সাঁই একজন আদ্ধাতিক মানুষ ছিলেন। তিনি মানবতাবাদের বাণী ছড়িয়েছেন। তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা আর মানবসেবার আহবানে সাড়া দিতেই আমরা প্রতি বছর এখানে আসি। ভারতের পশ্চিম বাংলার নদীয়া থেকে আসা সাধু অশিত বিশ^াস কালের কন্ঠকে জানান, আদ্ধাতিক এক মহা ধর্ম হচ্ছে মানব ধর্ম। লালনের সমস্ত গানে ও কথায় সেই মানব ধর্মের কথাই বলা হয়েছে। তাই সেই ধর্মকে ধারণ করে এবং দীক্ষা নিতে লালনের এই ধামে এসেছি। টাংগাইল থেকে আসা শাহ জমারত উল্লাহ বলেন, বিশবময় এখন হানাহানি চলছে। বিশ্বে জাতি-ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষকে একই স্রোতধারায় আনতে লালনের বানী সকলকে প্রেরনা জুগিয়েছে। তার অহিংসার বাণী ও জাতহীন দর্শনের টানে আমি বার বার আঁখড়া বাড়িতে আসি। বরিশাল থেকে আসা রমজান বয়াতী বলেন, লালন আমার আত্মার আতœীয়। তিনি একজন মহামানবও ছিলেন। কেন আসলাম তা নয়, আসব না কেন? তিনি তো বাউলদের শিরোমনি। তার ধামে আসতে তো আমাদের হবেই।
আয়োজকরা জানান, বাউল সম্রাট লালনের উদাসী গানের টানে বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো লাখো মানুষ ছুটে এসেছেন ছেঁউড়িয়ার আখড়া বাড়িতে। ফকির লালন শাহ’র আখড়া বাড়ী ও সামনের বিশাল মাঠ এখন ভক্ত-অনুসারী, সাধু-বাউল ও দর্শনার্থীদের পদভারে প্রকম্পিত। উৎসবকে ঘিরে মাজার চত্বরের এখানে-সেখানে আসন গেড়ে বসে পুরো এলাকায় সাধু-ভক্তরা লালনের অপূর্ব সব সুরের সাধনায় মত্ত হয়েছেন।
লালন একাডেমীর সভাপতি ও কুষ্টিয়ার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক শারমিন আখতার এখন খবরকে জানান, নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে এ বছর মেলায় লাখো মানুষের আগমন ঘটেছে। মানুষের ঢল সামলাতে হিমসিম খেতে হয়েছে আইন-শৃংখলায় নিয়জিত র্যাব, পুলিশ ও টুরিষ্ট পুলিশ সদস্যদের। তারপরেও আমরা অত্যান্ত সুষ্ঠ ও সুন্দর ভাবে এ আয়োজন শেষ করার প্রানান্তর চেষ্টা করছি। পুলিশ সুপার মো: মিজানুর রহমান জানান, উৎসবকে সফল করতে র্যাব পুলিশ ও টুরিষ্ট পুলিশের সমন্বয়ে শহর কেন্দ্রীক ও মাজার কেন্দ্রীক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
লালন একাডেমির খাদেম ফকির মোহাম্মদ আলী বলেন, আমরা সকলের সহযোগিতায় এবার সব কিছু ঠিক ঠাক মতো শুরু করতে পেরেছি। আর পরিবেশ অনুকুলে থাকায় গত বারের চেয়ে এবার লোকসংখ্যা বেশি হয়েছে। আগামী কাল শনিবার মধ্যরাতে এই অনুষ্ঠান শেষ হবে।