• মঙ্গলবার, ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ১০:২৭ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
কুষ্টিয়ার শহীদ আবরার ফাহাদ ষ্টেডিয়াম উদ্বোধন করলেন উপদেষ্টা আসিফ মাহামুদ বর্ণিল পরিবেশে কুষ্টিয়া জেলা সমিতি ঢাকার বার্ষিক বনভোজন ও মিলনমেলা অনুষ্ঠিত ঢাকায় অনুষ্ঠিত ১৯ তম ডিটিজি এক্সপো শেষ হয়েছে গতকাল বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে শেখ সাদী মোবাইলে টিকটক দেখা বন্ধ করে, পড়ার সময় পড়া ও খেলার সময় খেলতে হবে বিশিষ্ট সমাজসেবক আলহাজ্ব আলিমুদ্দিন শেখের ২য় মৃত্যুবার্ষিকী আজ বিশিষ্ট সমাজসেবক আলহাজ্ব আলিমুদ্দিন শেখের ২য় মৃত্যুবার্ষিকী আজ বিশিষ্ট সমাজসেবক আলহাজ্ব আলিমুদ্দিন শেখের ২য় মৃত্যুবার্ষিকী আজ কুষ্টিয়ার পদ্মায় ধরাপড়া বিশাল কুমিরটি বন বিভাগের হেফাজতে সাম্প্রতিক অতিথি মন্তব্য প্রতিবেদন হাসিনা পদত্যাগ করেন নাই, তিনি ক্ষমতা হারিয়েছেন. রাষ্ট্রপতির অপসারন সংকট সৃষ্টি করবে না

কথা এলোমেলো

Reporter Name / ১৮৪ Time View
Update : মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৪

সরওয়ার মুর্শেদ
আমরা মফস্বলের এলেবেলে মানুষ। ছোট্ট জেলা শহরে থাকি। এ শহরের বা জেলার নানা ঘটনা বা দুর্ঘটনার সংবাদ আমাদেরকে আলোড়িত করে। শিহরিত করে। কখনো কখনো ভয় পাইয়ে দেয়। এইসব খবর আমরা পাই নানা মাধ্যমে। কখনো লোকমুখে। জনশ্রুতি হিসেবে। এই জনশ্রুতির মধ্যে সত্য থাকে। অসত্যও থাকে। লোকমুখে এসব ঘটনা বা দুর্ঘটনা ছড়িয়ে পড়তে পড়তে নানা রূপ পায়। রং পায়। সত্য বিকৃত হয়। অনেক সময় মূল ঘটনাটি ঠিক বুঝে ওঠা যায় না। এসব ঘটনার বিবরণ আমরা সংবাদপত্রের মাধ্যমে অনেকটাই অবিকৃতভাবে পেয়ে থাকি। মফস্বল ও জেলা শহরের কোনো খবর খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলে সাধারণত জাতীয় পত্রপত্রিকায় ঠাঁই পায় না। প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষের খবরাখবরের প্রকাশমাধ্যম হলো স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা। এই বিবেচনায় জেলা শহর থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলো অত্যন্ত গুরুত্ববহ।
আমি ‘সংবাদপত্র’ প্রথম দেখেছিলাম কুষ্টিয়া পাবলিক লাইব্রেরিতে। সত্তরের দশক। তখন স্কুলে পড়ি। পাঠ্য বইয়ের বাইরের বই পড়ার ঝোঁক ছিল। এই ঝোঁক থেকেই আমরা পাবলিক লাইব্রেরিতে যেতাম। লাইব্রেরিতে অনেকগুলো জাতীয় দৈনিক পত্রিকা রাখা হতো। পাক্ষিক বা মাসিক ম্যাগাজিনও থাকত। মনে পড়ে বিচিত্রা, সন্ধানী ইত্যাদি ম্যাগাজিনের কথাও।
পাবলিক লাইব্রেরির উল্টো দিকে, নবান সিরাজ-উদ-দৌলা সড়কের দক্ষিণ পাশে ফিরোজ ভাইয়ের (পরে ‘বইমেলা’ নামে বইয়ের দোকান করেছিলেন) ‘সংবাদ বিতরণী’ নামে ছোট্ট দোকান ছিল। এখানে রাজধানী থেকে প্রকাশিত জাতীয় দৈনিকগুলো পাওয়া যেত। ফিরোজ ভাই স্থানীয় পত্রপত্রিকাও রাখতেন। তাছাড়া ‘ভালো বই’ এর জন্য এই দোকানটির খ্যাতি ছিল। শহরের বিদগ্ধ পাঠকেরা গুরুত্বপূর্ণ বই এবং জাতীয় দৈনিকের জন্য ফিরোজ ভাইয়ের শরণাপন্ন হতেন। কুষ্টিয়াতে তখনও দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ শুরু হয়নি। স্থানীয় পত্রিকাগুলো ছিল সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক। বাসা-বাড়িতে পত্রপত্রিকা রাখার খুব বেশি চল ছিল না। রুচির বিত্ত ও শিক্ষার বিত্তের সঙ্গে যাদের বেশি বেশি বিত্ত (আর্থিক সামর্থ্য) ছিল এবং পত্রপত্রিকা পাঠের বিশেষ আগ্রহ ছিল তারাই কেবল বাড়িতে দৈনিক পত্রিকা বা সাপ্তাহিক পত্রিকা রাখবেন। এখন যেমন জেলা শহরে শত শত মানুষের পেশা পত্রিকার হকারি করা; তখন তেমনটি ছিল না। হ্যাঁ হাতে গোনা দু একজন হকার ছিলেন। তারা নির্দিষ্ট পাঠকের বাড়িতে বা অফিসে বা দোকানে নিয়মিত দৈনিক পত্রিকা পৌঁছে দিতেন। প্রায় ক্ষেত্রেই হকারেরা পায়ে হেঁটে পত্রিকা বিতরণ করতেন। এখন দিন বদলে গেছে। পত্রিকার হকারের এখন বাহন সাইকেল। তখন ঢাকা থেকে জাতীয় দৈনিকগুলো আমাদের জেলা শহরে পৌঁছতে বিকেল হয়ে যেত। কখনো বা সন্ধ্যা হয়ে যেত। নিয়মিত পাঠকেরা যথাসময়ে পাবলিক লাইব্রেরিতে ঢুঁ দিতেন। এটা ছিল তাদের প্রতিদিনের জীবনের ছকে বাঁধা অভ্যেস। কোনো কারণে শহরে একদিন জাতীয় দৈনিক না এলে পাঠকদের মধ্যে এক ধরনের অতৃপ্তি দেখা যেত। কেননা তখন ঘরে ঘরে টিভি আসেনি। তাই পত্রিকার খবরই ছিল পাঠকদের কৌতূহল মেটানোর উপায়।
তখন স্কুলে পড়ি। পাঠ্য বইয়ের বাইরের বই পড়ার ঝোঁক। এই ঝোঁক থেকেই পাবলিক লাইব্রেরিতে যাওয়া-আসা আমাদের। তখন থেকে সংবাদপত্র পাঠের অভ্যাসও গড়ে ওঠে আমার। আমরা ছিলাম ছোটদের বইয়ের পাঠক। নুরু ভাই (নুুুরুল ইসলাম ভাইয়ের ছেলে আমাদের বন্ধু ছিল, তবু তাকে নরু ভাই বলতাম) ভাইয়ের দায়িত্ব ছিল ছোটদের বই আলমারি থেকে বের করে দেয়া। নরম করে কথা বলতেনÑ শিশুর মতো মন। আমাদের খুব ভালোবাসতেন। শিশু সাহিত্যিক জোবেদা খানম ছিলেন নুরু ভাইয়ের বড় বোন। আমাদের বই পড়তে খুব উৎসাহ দিতেন নুরু ভাই।
আমজনতার মধ্যে দৈনিক পত্রিকা পড়ার জন্য যাদের ভেতর তাগিদ ছিল তারা ঠিক বিকেল বা সন্ধ্যা হলেই পাবলিক লাইব্রেরিতে ভিড় করতেন। নানা বয়সের পাঠক। নানা রুচির পাঠক। ছোট-বড়র সে এক সম্মিলন। লাইব্রেরির ভেতরে পূর্ব-পশ্চিমে লাইন করে টেবিল সাজানো। দুপাশে সারিসারি চেয়ার। অসংখ্য পাঠকের সমাবেশ। কিন্তু লাইব্রেরির মধ্যে নিস্তব্ধতা। পাহাড়ের যেমন মৌনতা থাকেÑ তেমনি মৌনতা। দৈনিক পত্রিকা ও পছন্দের বইয়ের পাতায় সব পাঠকের নিমগ্নতা। এই নিমগ্নতার আশ্চর্য সৌন্দর্য ছিল। কেউ লাইব্রেরিতে ঢোকার সময় যেন অনেকটা সতর্ক হয়ে ঢুকতেন। পায়ের যেন শব্দ না হয়। আমরা লাইব্রেরিয়ানের কাছে বই চাইতাম প্রায় নিঃশব্দে কিংবা ফিসফিস স্বরে। বইয়ের আলমারির পাললা খোলা হতো খুব চুপিচুপি। একটি পত্রিকা বেশিক্ষণ ধরে পড়ার সুযোগ হতো না। কারণ পাশের পাঠক ওই নির্দিষ্ট পত্রিকাটির জন্য অপেক্ষা করতেন। ধৈর্য্যরে পরীক্ষা দিতেন। এমনকি উসখুসও করতেন। আহা কী অধীরতা! কারো আগ্রহ ছিল রাজনীতির খবরে। কারো খেলার খবরে। কারো বা সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের খবরে। সিনেমার খবরের প্রতি তরুণদের আগ্রহ ছিল ভীষণ। প্রিয় নায়ক-নায়িকার বিশেষ কোনো খবর থাকলে তো কথাই নেই। তেমনি খেলার খবরের ক্ষেত্রে কিছু পাঠকের ছিল প্রবল আগ্রহ। কেন মহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের তারকা খেলোয়াড় আবাহনীর বক্সে ঢুকে গোল মিস করলেন; কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্লাইভ লয়েড কীভাবে সেঞ্চুরি হাঁকালেন কিংবা সুনীল গাভাস্কারের কেন ধীর গতির ব্যাটিং করেন ইত্যাদি বিষয়ে জানার জন্য প্রবল আগ্রহ থাকত।
তেমনি রাজনীতির খবর জানতে কিছু পাঠক নিয়মিত লাইব্রেরিতে আসতেন। কোথায় খাল কাটা হলো কিংবা কোথায় ভাসানী ভাষণ দিলেনÑ এসব খবর জানার ব্যাপারে পাঠকের কমতি ছিল না। মফস্বল ও জেলা বা আশেপাশের জেলার খবর পাওয়া যেত স্থানীয় পত্রিকায়। এসব পত্রপত্রিকায় কখনো কখনো কয়েকদিনের বাসি খবরও ছাপা হতো। গুন্ডমির খবর, খুনের খবর, মারামারির খবর, আত্মহত্যার খবর এসব পড়ে আমরা অনেক সময় ভয় পেতাম। সন্ত্রস্ত হতাম। শঙ্কিত হতাম। বাড়িতে এসে সবার কাছে এসব ঘটনা বলতাম।
শুধু কুষ্টিয়া পাবলিক লাইব্রেরি নয়Ñ এ শহরে তখন আরো কিছু লাইব্রেরি ছিল। কোর্টপাড়ার আদর্শ লাইব্রেরি, আড়ুয়াপাড়ার তরুণ সংঘ পাঠাগার ও লাইব্রেরি, থানাপাড়া টাউন লাইব্রেরি, মিতালী পরিষদের লাইব্রেরি, লালন একাডেমির লাইব্রেরি ইত্যাদি। পরে টাউন লাইব্রেরি তুলে দিয়ে সেখানে ব্যায়ামাগার হয়। আরো পরে সেখানে ব্যায়ামাগার তুলে দিয়ে ধর্মীয় উপসনা গৃহ হয়েছে। মিতালী পরিষদের লাইব্রেরি ভবনটি বর্তমানে বিলুপ্ত। তরুণ সংঘ পাঠাগার ও লাইব্রেরিতে কেউ বই পড়ে না। সেখানে বাচ্চারা কেরাম খেলে।
সব লাইব্রেরিতে তখন জাতীয় দৈনিক এবং স্থানীয় পত্রপত্রিকা রাখা হতো। তবে পাবলিক লাইব্রেরির প্রতিই ছিল সবার আগ্রহ। এ লাইব্রেরির মাাঠে শহরের নানা সংগঠন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতো। রাজনৈতিক জনসভাও হতো। তাই লাইব্রেরির নিয়মিত পাঠকেরা এসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ এবং জনসভা শোনারও সুযোগ পেতেন। এ মাঠে আমরা রেল-শ্রমিক নেতা জসিম ম-লের অনেক বক্তৃতা উপভোগ করেছি। তিনি রসিয়ে রসিয়ে, আঞ্চলিক ভাষায়, কখনো বা ছড়া কেটে সরকারের সমালোচনা করতেন। পুলিশেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই সরস বক্তৃতা শুনে হাসত। পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে নানা জনসভায় অনেক জাতীয় নেতাকেও বক্তৃতা করতে দেখেছি। তবে যেদিন এই মাঠে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা রাজনৈতিক জনসভা হতো সেদিন লাইব্রেরিতে পত্রিকা বা বই পড়তে আসা কোনো কোনো পাঠক অসন্তুষ্টি নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। কারণ মাইকের উচ্চ শব্দে লাইব্রেরির ভেতরে পত্রিকা বা বই পাঠে মনোযোগ দেয়া যেত না।
এখন এ শহরে খুব ভোরে জাতীয় দৈনিকগুলো পৌঁছে যায়। চা-নাস্তা খাওয়ার আগেই রঙিন ছাপা দৈনিক পত্রিকা হাতে নিয়ে আমরা শিরোনাম পড়ি। এখন আমরা আর পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে পত্রিকা পড়ি না। হাতে গোনা কয়েকজন পাঠক পত্রিকা পড়েন। কালেভদ্রে দুই একজন বই পড়তে আসেন। কুষ্টিয়া পাবলিক লাইব্রেরির বইয়ের আলমারিগুলো প্রায় তালাবদ্ধ থাকে। পাঠক নেই। এভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা হয়তো কমে যাচ্ছে। বইয়ের পাঠক এখন সেল ফোনের দর্শক। আমিও হয়তো কিছটা বদলে গেছি। তবু প্রতিদিন সকালে দৈনিক পত্রিকা হাতে নিয়ে এখনো নিউজপ্রিন্টের গন্ধ শুঁকি।
লেখক: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়, কুষ্টিয়া


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category